নবম জাতীয় সংসদের ১৮তম এবং ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনের সূচনা দিন ৩ জুন ২০১৩, জৌষ্ঠ্যের অপরাহ্ন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি স্নরণীয় মুহুর্ত। এ দিন বিকেলে অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ডঃ শিরীন শারমিন চৌধুরী। মহান সংসদের ১২ তম স্পীকার তিনি। জাতীয় সংসদের বর্তমান সদস্যদের মধ্যে যারা স্পিকার হিসেবে দেখেছেন মালেক উকিল, মির্জা গোলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, শেখ রাজ্জাক আলি, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, জমির উদ্দিন সরকার এবং সর্বিশেষ আব্দুল হামিদকে, তাদের অনেকেই এখন কন্যাসম শারমিনকে দেখছেন অভিভাবকের চেয়ারে। পাঁচবারের এম পি এবং ডেপুটি স্পিকার হিসেবে অভিজ্ঞ শউকত আলিকে ডিঙ্গিয়ে যখন প্রথমবারের সংসদ সদস্য (তাও আবার মনোনিত নারী আসনের এম পি) শারমিন কে স্পিকার করা হয়, তখন রাজনীতির সব সমীকরণকেই মানিয়ে নিতে হয়। ১৯৬৬ সালে জন্মগ্রহণকারী রাজনীতিবিদ হিসেবে নবীন শিরীন শারমিন কিন্তু একদম উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সচিব। এলএলবি অনার্স ও এলএলএম ডিগ্রি নিয়েছেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে। স্পিকার হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই চার বছর সামলেছেন নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়, নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে বিরোধিতা ও সমালোচনা ও শুনেছেন।
দেখা যাক এ কদিনে কেমন হ্যান্ডেল করেছেন নতুন এই স্পিকার। প্রথম দিন নিজ হাতে লিখা যে বক্তব্য শিরীন শারমিন দিয়েছেন তা সর্বিমহলে আলোচিত,প্রশংসিত হয়েছে ইতিবাচক দ্রৃষ্টিভঙ্গের কারণে। জউহরলাল নেহেরু, শেখ মুজিব থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, রবার্ট ফ্রস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের মেধা ও পান্ডিত্যের প্রমাণ দিয়েছেন। মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, শিক্ষা ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা, অর্থনীতির সুচক প্রবৃদ্ধি সহ ইতিবাচক দিকগুলোকে বিশেষভাবে উল্লেখ করে এই অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন সম্মিলিতভাবে সবাইকে। আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট ও জাতিয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমাধানের পথ খোঁজার বিশ্বাস দেখিয়েছেন লিখিত এই বক্তব্যে। কর্মপ্রেরণা দেখিয়েছেন রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত চরণ বলে … And miles to go before I sleep । শেষ করেছেন রবীন্দ্রনাথে ভর করে ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।‘
বলা যায় সূচনা দিবসেই একটু ঝাঁজ দেখেছেন নতুন স্পিকার। বিএনপি সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু প্রথম দিনেই প্রশ্ন করেছেন- ‘অনির্বাচিত একজনকে স্পিকার করা গেলে অনির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত তত্বাবধায়ক সরকার মানতে অসুবিধা কোথায়?’ ধারালো এই শুরু দেখেই আঁচ করা যাচ্ছিল সংসদের কথার-তর্কের ক্ষুরগুলো আমাদের সমাধানের পথ দেখাতে পারে। টানা ৮৩ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর চলমান অধিবেশনের প্রথম দিনেই ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ্ব করার প্রতিবাদে ওয়াক আউট করে বিরোধী দল। কিন্তু পরদিন আবার সংসদে ফিরে এসে ইস্যুভিক্তিক তর্কের ঝড় তুলেন বিরোধী দল। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বরাস্ত্রমন্ত্রীর ব্যাংক ব্যবসা, মানবতাবিরোধী বিচার, মতিঝিলে কোরআন পড়ানো, মতিঝিল হত্যাকান্ড সহ নানা ইস্যুতে সংসদ উত্তপ্ত হয়েছে বারবার। নবাগত স্পিকার নমনীয়তার সঙ্গে ২৭০ ধারা অনুসরণ করে আক্রমনাত্নক, অশোভন ও কটু কথা পরিত্যাগ করে কথা বলার অনুরোধ করেছেন একাধিকবার। এমনকি বিএনপি এম পি আশিফা আশরাফীর উগ্র বক্তব্যের সময় সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী মাইক বন্ধ করার আহবান জানালে ও তাতে সাঁই না দিয়ে পুরো সময় সু্যোগ দিয়েছেন নতুন স্পিকার।
দুর্নীতিবিরোধী ইস্যুতে সোচ্চার ছিল সংসদ সদস্যরা। বিরোধীদলীয় সদস্য গোলাম মোস্তফা হলমার্ক ইস্যুতে সাইমুম, সুভাস ও হেনরির নাম উল্লেখ করে এদের বিচার না করে তানভীরের বিচার করলে বিচারের সাম্যতা থাকবেনা বলে দাবি করেন। হাতেগুনা এসব অভিযুক্ত রাজনীতিবিদ দের জন্য সরকার যে রীতিমত বিব্রত, তা নিজ এলাকায় তাদের অনুপস্থিতি, অগ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা হ্রাস প্রমাণ করে। ভার্সেটাইল পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে অন্যরকম আত্নবিশ্বাসে থাকা বিজেপি সাংসদ আন্দালিব পার্থ বাগ্নীতার পরিচয় দিয়েছেন আবারো। মার্জিত ভাষায় , যুক্তিকে পুঁজি করে সরকারকে রীতিমত নাকানি চুবানি খাওয়ানোর মত সব ইস্যু একত্রিত করে সেসব কে প্রেসেন্ট করার দক্ষতা আবারো দেখিয়েছেন তরুণ এই রাজনীতিবিদ। তবে এজন্য পাল্টা কথা ও শুনতে হচ্ছে তাকে। প্রয়াত বাবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির পুরাতন অভিযোগের তীরে তীর্য হয়েছেন। পদ্মা সেতু ইস্যুতে আবুল হোসেন ও মশিউর রহমান কে তুলোধুনো করা হয়েছে। সরকার দলীয় সদস্যরা ও ঘুরে ফিরে তুলে ধরেছে হাওয়া ভবন ও বিদ্যুৎ খাতের খাম্বা কেলেংকারি ইস্যু। প্রধান মন্ত্রী স্বয়ং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ১৫ হাজার ১১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা বকেয়া থাকার তথ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা খালেদা জিয়ার দুই ছেলে, প্রয়াত ভাই ও বিএনপির সাবেক দুই মন্ত্রীসহ কয়েকজন নেতার পনেরটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে পাওনা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হলমার্ক, ডেসটিনি সহ অর্থ কেলেংকারি ইস্যু যেখানে সরকার দলীয় নেতারা জড়িতের যৌক্তিক অভিযোগ আছে তা উদ্ধারের কোন পন্থার কথা উল্লেখ করেন নি।
বিরোধীদলের হাতে গুণা কয়েকজন বাগ্নী সংসদ সদস্যরা মূলত হিমশিম খাচ্ছেন সরকারের অজস্র আক্রমনাত্নক সংসদ সদস্যদের কথার তীরে। সরকার বিরোধী অনেক যৌক্তিক ইস্যুগুলো সংসদে ঠিকমত উপস্থাপিত হচ্ছে কিনা প্রশ্ন আসলে স্বাভাবিকভাবেই প্রসিদ্ধ পার্লামেন্টিরিয়ান মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অভাব পরিলক্ষিত হবে বিরোধী শিবিরে। সংসদে কিংবা বাইরে কথা বলতে না পারার জ্বালা মিটানোর চেষ্টা অবশ্য চলছে অবিরত। ট্রাইবুনালে প্রসিকিউটরের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন । রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিদের প্রসিকিউটর শব্দের আদলে ইংরেজি পারসিকিউটর (নির্যাতনকারী) বলতে দ্বিধাবোধ করেন নি নির্বাচিত এই সাংসদ। আড়াই বছর ধরে কারাগারে মানসিক নির্যাতনে রাখার অভিযোগ করেছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-১ এ নিজের জবানবন্দিতে পলাশীর যুদ্ধ, খেলাফত আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, চট্টগ্রাম প্রভৃত ঐতিহাসিক ইস্যুতে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন তিনি। কথায় কথায় শাসিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষকে এই বলে যে কালের পরিক্রমায় তার এই বক্তব্যগুলোই ডকুমেন্ট হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আত্নজীবনির রেফারেন্স টেনে তার পিতা মরহুম ফজলুল কাদের ও শেখ মুজিবের সুসম্পর্কের কথা শুনিয়েছেন ট্রাইবুন্যাল কে। দ্বিজাতিতত্ত্বে বঙ্গবন্ধুর সমর্থন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যতাবাদী শাসকদের হাতে ভারতের মুসলমানদের নির্যাতনের কথা নিজের ভাষায় তুলে ধরেছেন অকপটে। তৃতীয় নয়নে তাকালে আপাত মনে হবে ট্রাইব্যুনাল তর্কটি উপভোগ্য। কারণ রেফারেন্স ধরে ইতিহাস টানা হচ্ছে, তাত্বিক শব্দ প্রয়োগে প্রতিপক্ষকে শাসানো হচ্ছে, যদি ও কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অশুদ্ধ আচরণের অভিযোগ অনেক পুরনো। তবে সবচেয়ে মৌলিক একটি বিষয় কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে তুলে ধরেছেন। রাজনীতিবিদ দের সার্থ-সংস্লিষ্ট কোন সমিতি না থাকা নিয়ে অনুযোগ করেছেন তিনি। জবানবন্দিতে তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন- প্রতিটি পেশাজীবি সংগঠনের নিজস্ব সমিতি আছে, কিন্তু রাজনীতিবিদদের নেয়। তিনি নিজেদের (রাজনীতিবিদদের) মাংশাসী উল্লেখ করে বলেন একমাত্র আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরাই স্বজাতিদের গিলতে উন্মোখ হয়ে থাকে। সংসদের বাইরের এই ট্রাইব্যুনাল আমজনতার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে এর তথ্য-বিস্তৃতির কারণে।
লিখা শুরু করেছিলাম বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পীকারের রুচিশীলতা, তার প্রথম ভাষণ, পরিমিত সংস্কৃতিবোধ ও জাতির প্রত্যাশা পূরণে তার আকাংখার অনবদ্যতা নিয়ে। যে সংসদের নেতৃত্বে মহিলা, সংসদীয় নেতা, উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা মহিলা সে সংসদের নারী প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বর্তমান প্রজন্ম অনেক কিছু আশা করে। বাংলা মিডিয়াম কিংবা ইংলিশ মিডিয়ামের যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিসে সংসদীয় বিতর্কে নিজেদের অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে স্বপ্ন দেখে সত্যিকারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার , তারা কি আশাহত হবেনা যখন সত্যিকারের সংসদের অশ্লীল কোন শব্দ তাদের কানে শ্রবিত হবে। হোক সে শব্দ প্রাসঙ্গিক – আশির দশকের সাড়া জাগানো কবি “এখন যৌবন যার , এখনই যুদ্দ্বে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” খ্যাত হেলাল হাফিজের একটি কবিতা চরণকে উল্লেখ করার মাধ্যমে বি এন পি সাংসদ শাম্মী আক্তার কি নিজের অদম্য সাহসীকতাকে চেনাতে চেয়েছেন হাইকমান্ডের কাছে নাকি সংগ্রামকে চাঙ্গা করতে চেয়েছেন কর্মীদের কাছে, নাকি সরকারকে ফুসিয়েছেন – তা অনুমেয় নয়। তবে রাজপথের লড়াকু, সরকারের নিপীড়নের স্বীকার এই নারী সদস্য এই পংক্তিচরণ উদ্ধৃত না বললেই পারতেন – বিশেষ করে যেখানে অশ্লীল ও রুচিবিবর্জিত শব্দ আছে। নতুন শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে বি এন পি কে জনপ্রিয় করানোর জন্য তরুণ সদস্যদের দায়িত্বের অগ্রাধিকারগুলো ভাবা উচিত এবং তার জন্য তাদের কথা চারণ গুলো আরো মার্জিত ও সংযত হওয়া অবশ্যাম্ভাবী। তবে সব অশ্লীলতাকে ছাড়িয়ে গেছে সরকার দলীয় সদস্য অপু উকিলের কুৎসিত ও রুচিবিবর্জিত বক্তব্য। বিরোধী দলীয় নেত্রী ও তার দু সন্তান সম্বন্ধে যে প্রমাণহীন নোংরা অভিযোগ সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে, তা খবরের কাগজে প্রকাশ করতে গিয়ে দায়িত্বশীল সম্পাদক ও ছাপাতে ইতস্ততবোধ করবে। থু থু উপরের দিকে ছুড়লে তা নিজ গায়ে এসেই পড়ে- ব্যক্তিগত জীবন, রাজনীতি, সামাজিক রীতি সবখানেই এটি প্রযোজ্য। সস্তা জনপ্রিয়তার লেবাসে গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে সাময়িক বাহবা পাওয়া যায় ঠিকই, তবে নিজ এলাকার জনগণের প্রতি , সারা দেশের মানুষের প্রতি যে দায়বদ্দ্বতা একজন পলিসি মেকারের থাকা উচিত তা তাদের বিকৃত কথার মাধ্যমে প্রকাশিত হলে জনগণ সময়মত গলাধাক্কা দিতে মুহুর্ত দেরি করবেনা।
শেষ করছি হেলাল হাফিজের রাখাল কবিতার প্রথম কয়েক টি চরণ দিয়ে
আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম পোষা পাখি নাকি? ……
বাক স্বাধীনতাকে আলিঙ্গন করে আমাদের সংসদ সদস্যরা যদি যাচ্ছে তা আউড়িয়ে বেড়ায়, সাধারণ জনতাও পোষা পাখির মত অনুগত থাকবে না, প্রয়োজনে নিগৃহীত ও বিতাড়িত হবেন ইনারা, ব্যাঘ্র জনতার রোষানলে।