বিস্নয়করভাবে বাংলাদেশ এখন কয়েকটি দন্ত্য ‘স’ এর বলয়ে আবদ্ধ। সংকট, সংশয়, সংঘাত, সংলাপ, সর্বদলীয়, সমঝোতা এসব চলমান শব্দের ভীড়ে সংবিধানের সমীকরণে সমাধান বেরিয়ে আসবে সময়ের পরিক্রমায়।
সন্দেহ নেয় আমরা একটি সংকটময় সময় পার করছি। আড়ালের দেন-দরবার কে রৌদ্রুজ্জল করে বকাটে হাসির আভিজাত্যে এরশাদের জাতিয় পার্টি নির্বাচনকালীন সরকারে যে বেশভূষা অন্তত পেল তা দেখে লোলুভ নেতাদের বস্তুগত চাহিদা আরো বেড়ে গেছে। এখন তাদের তৃপ্তির ঢেকুর তুলাটা উপভোগ করবে খোদ সরকারী দল। কথিত নির্বাচনকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু প্রতিমন্ত্রীর পদ পাওয়া যমুনা গ্রুপ কর্ণধার বাবুলের স্ত্রী জাতিয় পার্টি নেত্রী সালমা ইসলামের কদমবুচির জবাবে প্রধানমন্ত্রী যখন আদুরে গলায় আহ্লাদ করে ‘এবার খুশি তো?’ বলে, তখন জাতি হিসেবে আমরা প্রহসনের চুড়ান্ত সক্রেটিস মঞ্চনাটক উপভোগ করি যেন। এ মঞ্চ নাটকের উপকরণগুলো এত বিশেষায়িত যে নির্বাচিতদের অধীনে নির্বাচনের যে স্ব-প্ররোচিত আস্ফালন তা হুমকির মুখে দাঁড়ায়। তাইতো ঊনত্রিশ জন নির্বাচিত মন্ত্রীর (টেকনোক্রেট সহ) বিপরীতে এগারজন অনির্বাচিত উপদেষ্টা নিয়োগ কে সংবিধানের আলোকে অবৈধ বলা না গেলেও নীতির প্রশ্নে তা জাতির সঙ্গে চরম এবং চুড়ান্ত পরিহাস। এ পরিহাসের মাত্রা এতটা জন্ডিসাক্রান্ত যে জাতিয় পার্টির আটাশ জন নির্বাচিত সাংসদের বিপরীতে সাতজনের মন্ত্রীত্বলাভ ছাপিয়ে যায় আওয়ামিলীগের দুশ বিশ জন সাংসদের বিপরীতে বিশজনের মন্ত্রীত্বলাভকে। ছিয়াশির নির্বাচনের প্রতিদান হিসেবে না দেখলে ও কিসের আকাঙ্ক্ষায় হু মো এরশাদ এত মন্ত্রীত্ব বাহুমন্ডিত করলেন তার বিশ্লেষণে যাওয়াটা সময়েক্ষেপন করার নামান্তর। পরাজিত স্বৈরশাসক গণতন্ত্রের নির্যাস কে নিজের সুবিধাভোগের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখবে, তাইতো স্বাভাবিক।
অপরদিকে আওয়ামিলীগ গণতন্ত্রের ধারার রাজনৈতিক দল। বিরোধী দল কে রাজনৈতিক ভাবে কূপোকাত করতে তারা সবধরনের কৌশল প্রয়োগ করবেন- তাই স্বাভাবিক। একদিকে জাতিয় পার্টিকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে খুশিতে বুঁদ করে নির্বাচনোত্তর সরকার গঠনের অভিলাসের দিবা স্বপ্ন দেখাচ্ছে, অন্যদিকে অনেক মৌলিক বিষয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিএনপি কে এরশাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। আমরা সবিস্নয়ে লক্ষ্য করি – বিএনপি নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের দাবিকে পাশ কাটিয়ে এরশাদ বিরোধী বিশাল মিছিল করে রাজপথ গরম করছে। আপাতত বিএনপি কে দৃষ্টিভ্রম করার কৌশলটি পরিস্থিতিকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কার্যত।
কথিত সর্বদলীয় সরকারের যাত্রা শুরুর তারিখ নিয়েও পরস্পর বিরোধী তথ্য-বিতর্কে যুক্ত হয়েছে সরকারী দল। কেউ বললেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদে দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে নির্বাচন কালীন সরকারের, আবার কেহ বললেন নির্বাচন কমিশনের তফসির ঘোষণার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হবে। যখনই শুরু হোক না কেন, এ জি-হুজুর সরকারের মধ্য থেকে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসণের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব তুলে দেবার মত বিশ্বস্ত কাউকে খুঁজে পেলেন না প্রধানমন্ত্রী। সাময়িক বাহবা পাওয়ার নেশায় যারা এ সরকারকে সর্বদলীয় কিংবা তথ্য মন্ত্রীর ভাষায় বহুদলীয় সরকার বলেন – তাদের বিবেকের দংশন কি সোহরাওয়ার্দি, ভাসানি, বঙ্গবন্ধু , তাজউদ্দিনের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে-না। বলতে সমস্যা কোথায় – চলমান মহাজোট সরকারের পরিশোধিত রুপের মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে। রাশেদ খান মেনন যখন একই মন্ত্রীসভায় স্বৈরাচার এরশাদের মনোনিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে নির্বাচনী পরিবেশ(!) নির্ধারণ করবেন , নুর হোসেনের আত্নার করুণ আহাজারি এ প্রহসন কে আরো পলাশীময় করে তুলবে।
সংলাপ আয়োজন নিয়েই যেখানে অনেক মিথ্যাচার হচ্ছে সেখানে পরবর্তীতে গঠনমূলক আলোচনা ও ফল আসা করাটা এ মুহুর্তে অমাবস্যার চাঁদ। তাইতো মহাসচিব-সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ের আলোচনা থেকে ভাল কিছু আশা করতে হলে অতিমাত্রায় আশাবাদি হতে হবে। তারপর ও একটু আশাবাদি হওয়ার কারণ হচ্ছে – এ প্রথম দু দলের দু দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছেন আর তা গোপন করতে চাচ্ছেন। এটি ভাল লক্ষণ, প্রথমত- এতে সংলাপের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি বলে ক্যামেরা দেখানো আড়ম্বর নেয় আর দ্বিতীয়ত- যেহেতু সরকারী দলের সাধারণ সম্পাদক বিরোধী দলের কতিপয় সাংসদের বাসায় আলাপ করতে গেছে বলে খবরে প্রকাশ, তাতে সরকারের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কিঞ্চিৎ থাকতে পারে বৈকি।
সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে দেশের অস্থির এ সময়ে। বহুল প্রচলিত দৈনিক প্রথম আলো সংবিধান বিশ্লেষণের ধারাবাহিক লিখনীতে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে তুলনা করে নীতিহীন বলেছেন। ইত্তেফাক তাদের জরিপে আওয়ামিলীগের জনপ্রিয়তা বেশি বলে খবর ছাপানোর কিছুদিনের মধ্যে আনোয়ার হোসেনকে মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা করে পুরুস্কৃত করা হয়েছে। আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে শংকা প্রকাশ করে সরকারের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। তাদের আশংকা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের নানাবিধ চাপে পড়তে পারে যদি উদ্ভূত পরিস্থিতির উন্নতি না হয়। রিপোর্টটিতে চলমান সংকটের জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দায়ি করা হয়েছে এবং বিচার ব্যবস্থার স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার আহবান জানানো হয়েছে।
সরকার আন্তর্জাতিক কূটনীতি নিয়ে তাদের নিজেদের মত হিসেব করে রেখেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে দীপু মনিকে সরিয়ে অভিজ্ঞ ডিপ্লোম্যাট মাহমুদ আলিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে ভারত-চীন কে সামলে যুক্তরাষ্ট্র কে মানিয়ে চলতে কতটুকু পারদর্শিতার পরিচয় এ ক্ষণকায় সরকার দিবে তা বুঝতে হলে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। টিকফা চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার সন্তুষ্টি অর্জন কতটুকু সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথাটি হল – যদি চলমান সরকারটি সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনকালীন সরকার ই হয়, তাহলে যেকোন ধরণের চুক্তি সাক্ষর সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের আওতার মধ্যে পড়ে যার একতিয়ার নিয়ে সংবিধানে প্রশ্ন উঠতে পারে। রোববার থেকে নব্য সরকারের মন্ত্রীরা দাফতরিক অফিস করা শুরু করেছেন । একইদিন অর্থমন্ত্রী নিজের আকর্ষিত ভঙ্গিমায় দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন – নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যসূচী শুরু হবে নির্বাচন কমিশনের তফসির ঘোষণার মধ্য দিয়ে। যদি তাই হয়- তবে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত নতুন মন্ত্রীদের দাফতরিক কার্যক্রমকে নির্বাচন কালীন সরকারের অংশ নাকি মহাজোট সরকারের কার্যক্রম বলা যাবে তার ব্যখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। পাছে বেশি জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবার স্টুপিড বলে বসেন। অর্থমন্ত্রীর এ ব্যখ্যার মধ্য দিয়ে টিকফা চুক্তি সম্পাদনের জন্য নির্বাচন কালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর এড়ানোর খেয়াল আছে হয়ত। সত্যিই স্টুপিড জনগণ।
সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলছে যে বিষয়টি – তা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সমণ্বয়হীনতা ও অসামাঞ্জস্যতা। এখনো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছাড়া আস্থা অর্জনের মত কোন কিছু এ কমিশন করে দেখাতে পারেনি। উল্টো ধোঁয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে অনেক মৌলিক বিষয় নিয়ে। এর আগে কমিশনার জাভেদ আলি বিএনপির সঙ্গে আলোচনা এগুচ্ছে বলে বিরাগভাজন হয়েছেন নিজেদের মধ্যে। অতিরিক্ত সরকার তোয়াজ ও মিডিয়ায় অপ্রিয় কথা বলাকে কেন্দ্র করে অধুনা কমিশনারদের মধ্যে মনস্তাত্বিক বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে বলে সংবাদ এসেছে। নাটকীয় এ সরকারের সব কার্যসূচীর বাইরে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল ভূমিকার অপেক্ষায় রয়েছে শান্তিকামী মানুষ।
সংকটময় এ পরিস্থিতির সুস্থ সমাধানের স্বপ্ন সফলময় নাকি অঙ্কুরে বিনষ্ট হবে তা নিশ্চিত করবে শক্তিশালী দন্ত্যস ‘সময়’।
একমাত্র সময় ই বলে দিবে আমাদের আগামির পথচলা। রাজনীতিবিদ দের এ কথা ভুলে গেলে চলবেনা – একমাত্র সময় ই তাদের উচ্চাসনে বসায় অথবা আস্তাখুড়ে নিক্ষেপ করে। পলাশির প্রান্তরের মীর জাফর কে যেমন আমরা ঘৃনাভরে স্নরণ করি একইভাবে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্নরণ করি স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু, ভাসানি, শহীদ জিয়াসহ মহান দেশপ্রেমিক নায়কদের। অনেক নিন্দা, সীমাবদ্ধতার পর ও আমরা বীরদের স্নরণ করি কারণ দেশের ক্রান্তিলগ্নে তারা নিজেদের ব্যক্তিসার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের মানুষের সার্থে নিজেদের আত্ননিবেদিত করেছিল।
সময়ের একফোড় শেষ হওয়ার আগেই সজাগ হতে হবে আমাদের রাজনীতিবিদদের অন্যথায় ওয়ান-ইলেভেনের মত অসময় এসে গেলে সংকটের নতুন মাত্রা যোগ হবে।