Feeds:
Posts
Comments

Archive for the ‘সুন্দরবন’ Category

রমজানের পরই শুরু হবে দেশীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সময়। নির্বাচনমুখী এ সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। সংকটকালীন এ সময়ে দেশীয় রাজনীতিতে গুরুত্বহীন অথবা ঢাকা পড়ে যেতে পারে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গূরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু। সুন্দরবন ঘেঁষা রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র বাস্তবায়ন এরকম একটি দরকারি এজেন্ডা যার পেছনে লুকিয়ে আছে দেশের স্বার্থবিরোধী অনেক মৌলিক বিষয়। আজকের লিখাতে এসবে মনযোগী হব।

খুব বেশিদিন হয়নি – আমরা সুন্দরবন কে নিউ সেভেন ওয়ান্ডারসে আনার জন্য ব্যপক প্রচারণা চালিয়েছি। এর আগে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত  কক্সবাজারকে নিয়ে ও  চেষ্টা করেছি বিশ্বের বুকে আশ্চর্যময় প্রাকৃতিক আবিস্কার হিসেবে স্বীকৃত করতে। ধরতে গেলে আমাদের দেশের দুটি অন্যতম অর্জন কিংবা সম্পদ হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত ও দীর্ঘতম ম্যানগ্রুভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কূটনৈতিক  তাৎপর্য্য ও অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে সমুদ্র দিবস (৮ জুন) এ লিখেছি – আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সামগ্রিক কল্যানে সমুদ্রের অবদান  সর্বজনবিদিত।  আর সুন্দরবন কে ও নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেয়।  বাংলাদেশের মোট সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ সুন্দরবনে, আর জগত বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার তো আছেই । সেই সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষা বাগেরহাট জেলার এক উপজেলার নাম রামপাল। এই রামপালে আসন্ন সেপ্টেম্বরে কয়লাভিক্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্ভোবনের পরিকল্পনা করছে আমাদের সরকার।

২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালীন সময়ে ভারত সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কিছু সমঝোতা স্নারকে সাক্ষর করে, এর মধ্যে একটি ছিল সুন্দরবন বাফার জোনের চার কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ভিক্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরের ২০ এপ্রিল ভারত সরকারের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি স্থাপিত হয়। জানা গেছে সামনের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটি উদ্ভোবনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং কে আমন্ত্রন জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে চিঠি ও দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। অথচ বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহলের গভীর চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে এ বিদ্যুৎ প্রকল্পটি শুধু সুন্দরবনের জন্য পরিবেশেগত হুমকিই  নয়, বানিজ্যিকভাবে ও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।  আশংকা রয়েছে মানবিক বিপর্যয়ের ।

প্রথমেই খতিয়ে দেখি বানিজ্যিক প্রেক্ষাপটগুলি। ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। প্রকল্পের জন্য জমি প্রয়োজন সর্বোচ্চ ৭০০ একর কিন্তু অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১৮৪৭ একর। গবেষণার  তথ্যানুযায়ী কয়লাভিক্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য প্রয়োজন শুন্য দশমিক ৪২ একর জমি। এ হিসেবে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজন ৫৫৫ একর জমি। এর সঙ্গে টাওয়ার সহ আনুসঙ্গিক নির্মানার হিসেব করলে জমি দরকার সর্বোচ্চ ৭০০ একর। কিন্তু বাস্তবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে অতিরিক্ত ১১৪৭ একর জমি। স্থানীয় বাসিন্দারা এ অধিগ্রহণ কে দেখছেন সন্দেহের দৃষ্টিতে। অতিরিক্ত জমি অন্যখাতে ব্যবহার হবে কিনা তা নিয়ে স্থানীয়দের অনেক জল্পনা কল্পনা। তাদের ধারণা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পর সুন্দরবনে তেল গ্যাস অনুসন্ধান প্রকল্প ও নেওয়া হতে পারে। যদি ও কতৃপক্ষ বলছে অতিরিক্ত জমি নেওয়া হয়েছে বর্ষার মৌসুমে তিন মাসের কয়লা মজুদের জন্য, তবে এ ব্যখ্যা নিতান্তই কান্ডজ্ঞানহীন। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে দানা বেঁধেছে সন্দেহের বীজ।

মনযোগ দেওয়া যাক প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেওয়া হবে, বাকি ৩০ শতাংশ সমানভাবে ভারত ও বাংলাদেশ জোগান দিবে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি ও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কিন্তু এর পরিচালনায় থাকবে ভারতীয় কোম্পাণি এনটিপিসি। ভারতের শর্তানুযায়ী সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সিদ্বান্তে কোম্পানির লভ্যাংশের উপর এনটিপিসিকে দশ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি কর্পোরেট ট্যাক্স  ও মউকুফ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্যই বা কেমন হবে। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হবে একটি ফর্মুলা অনুসারে। ফর্মুলাটি হচ্ছে – যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয়, তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা। আর যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১৪৫ ডলার হয়, তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতি টন কয়লার দাম ১৪৫ ডলার চুড়ান্ত করা হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ কিনতে চায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। বর্তমানে বাংলাদেশ আনোয়ারা ও মুন্সিগঞ্জের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র (ওরিয়ন গ্রুপের) থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে যার গড় প্রতি ইউনিট সাড়ে তিন টাকার ও কম। এখন প্রশ্ন হল, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে কেনার পর তা গ্রাহকের কাছে কি দরে বিক্রি করা হবে? সরকার কি এক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে? যদি তাই হয়, সরকার কি এ প্রকল্প থেকে আদৌ লাভবান হবে নাকি লাভের চেয়ে ক্ষতির মাত্রাই বেশি হবে?

 

এবার দেখা যাক পরিবেশগত হুমকিগুলো। বায়ু ও পানি দূষণের কারণে বিশ্বব্যপী কয়লা ভিক্তিক প্রকল্পগুলিকে নিরুৎসাহিত করা হয় কিংবা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়। কয়লা ভিক্তিক প্রকল্পে প্রতি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানি প্রয়োজন। রামপাল প্রকল্পে বিশাল পানির প্রয়োজন মেটানো হবে সুন্দরবনের পশুর নদী থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে পশুর নদীর পানি নোনা ও মিঠা পানির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে এবং ম্যানগ্রুভ বনাঞ্চলের প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করে। পশুর নদীর সঙ্গে সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। রামপাল প্রকল্প করতে গিয়ে যদি আমরা পশুর নদীর নাব্যতা কিংবা পানির স্রোতকে নষ্ট করে ফেলি তবে তা সুন্দরবনের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।

এ ছাড়া প্রকল্প নির্মাণের জন্য মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভিতর নদী পথে আনা নেওয়া হবে। তেল নিঃসরণ, শব্দ দূষণ, বর্জ্য নিঃসরণ সহ নানবিধ যান্ত্রিক কারণে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ও প্রকট। ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি থেকে নির্জিত গ্যাসের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস যা আশেপাশের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিবে। তাছাড়া প্রকল্পের কারখানা থেকে নিঃসরিত ভিবিন্ন ক্ষতিকর ক্যামিকাল শুধু পানি , বায়ু দুষণ ই করবেনা বরঞ্চ সুন্দরবনের রয়েল ব্যাঙ্গল টাইগার সহ প্রাণী বৈচিত্রের অস্তিত্বের জন্য মারাত্নক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে এ প্রকল্প সর্বসাকুল্যে ৬০০ জন লোকের কর্ম সংস্থান করবে, অন্য দিকে ১৮৪৭ একর জমি অধিগ্রহণের কারণে ৮ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে অত্র এলাকা থেকে। এ সঙ্গে বিনষ্ট হবে বিপুল কৃষি সম্পদ।  প্রসঙ্গত ভারতের মধ্য প্রদেশে এই এনটিপিসি কোম্পানি প্রস্তাবিত কয়লা ভিক্তিক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রনালয়। তারা পরিবেশ বিপর্যয়, নিকটবর্তী জনবসতি, পানির স্বল্পতা সহ বিবিধ কারণ দেখিয়ে প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। আমরা কি ভাবতে পারিনা, যে বিবেচনায় এনটিপিসি  নিজ দেশে কাজ করতে পারেনি, একই বিবেচনায় আমরা ও আমাদের সুন্দরবন কে রক্ষা করতে পারি।

সম্প্রতি রামপাল প্রকল্প বাতিলের জন্য লংমার্চ কর্মসুচি ঘোষণা করেছে তেল গ্যাস রক্ষা কমিটি। বিরোধী দল অঙ্গীকার করেছে তারা ক্ষমতায় আসলে প্রকল্পটি বাতিল করবে। আদালতে ও ঝুলে আছে রামপাল প্রকল্প বাতিল ও সুন্দরবন রক্ষার একটি রিট আবেদন।  যেই সুন্দরবন ২০০৭ সালের সিডর থেকে আমাদের বাঁচিয়েছিল, সে সুন্দরবন কে তার নিজস্বতাই টিকিয়ে রাখা আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, দেশপ্রেম দিয়ে রক্ষা করতে হবে সুন্দরবনকে। অন্যথায় রামপালে তথা সুন্দরবনে বাঘের করুণ আর্তনাদ শুনার বেশিদিন আর দেরি নেয়।

Read Full Post »