সম্প্রতি বিসমটক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অকপটে বললেন , ‘তিস্তা চুক্তি কঠিন বিষয়’ তখন কূটনীতির শিষ্টাচার ও রাজনীতির ধারাভাষ্য বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যায় তিস্তা চুক্তি আপাতত হচ্ছেনা। যদি ও গত ছয় বছর ধরে ঢাকায় তথাপি পুরো দেশে এমন আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে মনে হচ্ছিল তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি সময়ের ব্যপার মাত্র। এ অবস্থায় বিএনপি র মত বড় রাজনৈতিক দল অনেকদিন পর একটি মৌলিক ও কার্যকর কর্মসূচী দিল তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচী দেওয়ার মাধ্যমে।
তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটি নিলফামারী জেলার খড়িবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।১৭৮৭ সালের অতিবৃষ্টি সৃষ্ট একটি বন্যায় নদীটির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিমি, তার মধ্যে ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত।
তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে যেখানে নাব্যতা বজায় রাখতে ন্যুনতম পাঁচ হাজার কিউসেকের বেশি পানি প্রয়োজন সেখানে সম্প্রতি পানি প্রবাহ সর্বনিম্ন পাঁচশ কিউসেকে এসে দাঁড়িয়েছে। পানির অভাবে সংশ্লিষ্ট কৃষক জমি তৈরি করতে পারছেন না। যেসব জমিতে বোরো চারা রোপণ করা হয়েছে তা মরে যাচ্ছে। রংপুর বিভাগের তিন জেলায় ১২ উপজেলার প্রায় ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বোরো চারা সেচের অভাবে মরে যাওয়ার খবরটি আমাদের কৃষি নির্ভর অর্থনীতির জন্য নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক উদ্বেগজনক।
ভারত – বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশের সদস্য মারফত খবরে জানা গেছে, গত বছর আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার কিউসেক (কিউসেক = প্রতি সেকেন্ডে এক ঘন ফুট)। পানি পাওয়া গেছে যা ছিল পঞ্জাশ শতাংশ কিন্তু এবার তা সাত থেকে দশ শতাংশে নেমে এসেছে। গত মাসের নয় তারিখ পানি প্রবাহ ছিল চারশ নয় কিউসেক যা অস্বাভাবিক কম। প্রতিবাদে রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার ক্ষুদ্ধ কৃষকরা সড়ক অবরোধ সহ অনেক কর্মসূচী ও পালন করেছেন। অনেক কৃষক তিস্তার পানি না পাওয়ার কারণে শ্যালো-মেশিন নির্ভর বিকল্প সেচ ব্যবস্থার চেষ্টা ও করছেন। তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ এ বছর আর বাড়বে কিনা তার কোন গঠনমূলক ঊদ্যোগ এখনো সরকার থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। আমাদের বিরোধী দল, সুশীল সমাজ ও কোন চাপ সৃষ্টি করছেন না। এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তি না হওয়ার কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপতর হচ্ছে। যদিও আপাতত সাময়িকভাবে অন্তত প্রশাসনিকভাবে সমঝোতার মাধ্যমে পানি বন্টনের একটি ব্যবহারিক সিদ্বান্তে পৌছানো যেত বৈকি।
তিস্তার পানি নিয়ে এই ভারসাম্যহীনতার মূল উৎপত্তি সীমান্তের প্রায় ৫০ মাইল উজানে মেকলিগঞ্জের গজলডোবায় যেখানে একটি ব্যারাজের মাধ্যমে একপাক্ষিক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ব্যারেজের দুটি সেচ খালের মাধ্যমে নিয়মিত পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে প্রায় নয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। ঊদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ভারত তিস্তার পানি সরিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমে অন্যান্য দূরান্তের অববাহিকাতে যা দিয়ে ওখানে কৃষি কাজ চলছে। আমাদের কৃষকরা বিকল্প হিসেবে গভীর নলকূপ থেকে পানি তোলে যখন সেচ ব্যবস্থা নেয় তখন বিঘা প্রতি ধান আবাদের খরচ বেড়ে যায় ৩-৪ হাজার টাকা। অথচ তিস্তার পানি ব্যবহার করলে খরচ হয় বিঘা প্রতি ১৬০ টাকা। এই হিসাব থেকে দেখা যায়, কেবল তিস্তার পানি বঞ্চনার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের সাধারণ কৃষকের শত শত কোটি টাকা ক্ষতির কারণ হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের গণমাধ্যম গুলোও গঠনমূলক সমালোচনা করছেনা।
গত বছরের শেষ দিকে ভারতের ‘জল কমিশনের’ চেয়ারম্যান অশ্বিন পান্ডে তিস্তায় পানি বণ্টনের জন্য নতুন সমীক্ষা করার ঘোষণা দিলেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও পানিপথ মন্ত্রী রাজিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের কতটা জল দরকার, বাংলাদেশের কতটা জল দরকার- তা প্রথমে নির্ণয় করা দরকার। এর জন্য কারিগরী ও আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা প্রয়োজন। সেই কাজ শুরু হলো।’ কলকাতার গণমাধ্যম তিস্তায় নতুন এই সমীক্ষাকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিরাট বিজয়’ হিসেবে দেখাচ্ছে। কারণ মুখ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় বিজেপির নেতৃবৃন্দ প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে- তিস্তায় বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো ‘বাড়তি জল’ নেই এবং নতুন সমীক্ষা ছাড়া কোন মতেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার প্রবাহ নিয়ে কোন চুক্তি করা যাবে না। এমতাবস্থায় আমাদের রাজনীতিবিদদের ভাববার প্রয়োজন আছে গত ছয় বছরধরে কি শুধুই পানি ঘোলা করা হয়েছে কিনা। নাকি পার্শবর্তী দেশের রাজনৈতিক দাদাগিরির বলি হচ্ছি আমরা।
২০১১-এর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের বাংলাদেশের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতাকে ‘দায়ি’ করে তাঁর একগুয়েমিকে অগ্রাহ্য করার হুমকি দিলেও গত মাসে মায়ানমারে তৃতীয় বিমসটেক সম্মেলনে মনমোহনের কূটনৈতিক শেষকথা এবং ‘জল কমিশনের’নতুন সমীক্ষাই বলে দিচ্ছে পুরো বিষয়টি ছিল সময়ক্ষেপন মাত্র। ২০১১ এর ‘সম্ভাব্য চুক্তির খসড়া বিনিময়ের পর’ এখন নতুন সমীক্ষার কথা বলা হচ্ছে- যা আমাদের কূটনীতিক কৌশলের এক ধরণের পরাজয়। এদিকে, যদিও দুটি দেশের সরকারই এ মুহূর্তে গভীর বন্ধুত্বের অভিনয় করছে কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অমিমাংসিত সমস্যার তালিকা মোটেই কমছে না। বিশেষ করে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ও তিস্তার পানি বন্টন সমস্যার কোন সুরাহা না পেয়ে বাংলাদেশের ব্যর্থতার পাল্লা বেশ ভারী হয়ে উঠছে।
দুদেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে গত অর্ধযুগের বৈঠকগুলো অনুসরণ করলে দেখা যায়, সিদ্বান্ত যা হচ্ছে – সবই ট্রানজিট ও নিরাপত্তা বিষয়ে, আর তিস্তা, বাণিজ্য, সীমান্ত চুক্তি বিষয়গুলো নিয়ে কেবল আশাবাদ ব্যক্ত করে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে – কূটনীতির অভীক্ষায় শূন্য গহ্বরেই আমরা রয়ে যাচ্ছি মূলত। কূটনীতির সার্থের মূল কথায় হচ্ছে কোন কিছুর বিনিময়ে কোনকিছু আদায় অথবা অর্জন করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারত পানি না দিয়েই করিডোর সুবিধা পেয়ে গেছে উপরন্তু বিদুতের এক বড় ক্রেতা হিসেবেও তারা বাংলাদেশকে পেয়েছে।