কোন সন্দেহ নেয় সারা দেশ এখন প্রবল উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সবদিকেই রাজনীতির সমকালীন এ প্যাঁচের প্রভাব পড়ছে। এ মুহুর্তে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নীচের চারটি সম্ভাবনার যে কোন একটির দিকে যাচ্ছে মূলত।
(১) সরকার – বিরোধী দল পারস্পরিক ছাড়ের মানসিকতায় আলোচনায় বসবে। আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বেরিয়ে আসবে এবং সর্বোদলীয় নির্বাচনের দিকে দেশ অগ্রসর হবে।
(২) ক্ষমতাসীন দল বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের আয়োজন করবে। সহিংসতা বাড়বে। আঠারো দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করবে আর নির্বাচনোত্তর সরকারের স্থায়িত্ব কতদিন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
(৩) সরকার নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকবে। বিরোধী দল রাজপথে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কে ব্যবহার করে জরুরী অবস্থা জারি হবে। সংকট প্রবলতর হবে।
(৪) অগণতান্ত্রিক শক্তির উন্মোচন হবে যার প্রভাব লংটার্মে খুব সুখকর নয়। আমাদের নিকট অতীতে তা আমরা বারবার দেখেছি।
অনস্বীকার্য এবং অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে, আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রথম সম্ভাবনাটির কার্যকরিতাই সবার প্রত্যাশিত ও আকাঙ্ক্ষিত। উপরিউল্লিখিত চারটি সম্ভাবনা অনেকটা ‘যদি-তবে’ নির্ভর, অর্থাৎ যদি প্রথমটি না হয়, তবে দ্বিতীয়টি। যদি দ্বিতীয়টি না হয়, তবে তৃতীয়টি…এভাবে।
আমি আশাবাদি মানুষ এবং বিশ্বাস করি এ দেশের অধিকাংশ মানুষই তাই। প্রথম সম্ভাবনাটিই আলোচনা করি।
ঈদের ছুটির রেশ কাটতে না কাটতেই জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জট খুলার প্রথম প্রয়াস ছিল। ‘এক চুল নড়বনা’ ঘোষণা থেকে সরে এসে বিরোধী দল থেকে মন্ত্রীত্বের লিস্ট চেয়ে প্রস্তাব দিলে ও প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে খোলাসা না করাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি মূলত অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক ঠেকে বিরোধী দলের কাছে । পরবর্তীতে বিরোধী দলীয় নেত্রীর দেওয়া ৯৬ ও ২০০১ সালের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ৫ জন করে উপদেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাবে নির্দলীয় তত্বাবধয়ায়ক সরকারের ছায়া থাকলে ও এর সত্যিকারের কার্যকারিতা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন উঠে। দু নেত্রীর পাল্টাপাল্টি প্রস্তাবদ্বয় যুক্তি-তর্কে শতভাগ গ্রহণযোগ্য না হলেও জাতির সামনে সমস্যা সমাধানের আলো হয়ে আবির্ভূত হয়। তবে সবচেয়ে প্রত্যাশিত চমকটি আসে যখন বিরোধী দল সংসদে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করে। সরকারের তরফ থেকে বারবার আহবান করা হচ্ছিল যাতে বিরোধী দল যে কোন প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করে। এরই ধারাবাহিকতায় জমির উদ্দিন সরকারের মাধ্যমে যখন প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়, সরকারী দলের তোফায়েল আহমেদ তার বাগ্নীতায় প্রস্তাবটি খন্ডান। পরবর্তীতে এম কে আনোয়ার অনেক সহনশীল এবং গঠনমূলক ভাবে প্রস্তাবটির মূল উদ্দেশ্য সংসদে তুলে ধরেন এবং ক্যাটাগরিক্যালি সরকার প্রধান নিয়ে বিতর্ক সমাধান হলেই বাকি সদস্য অন্তর্ভুক্তির সমস্যা সমাধান হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন। কিন্তু এর পরেই আওয়ামিলীগ সিনিয়র সদস্য শেখ সেলিম অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামাল টেনে আনলে সরকারের সত্যিকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং বিরোধী দল ওয়াক আউট করে। সংসদীয় তর্কাতর্কি তে সমাধানের পথ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
২৪অক্টোবর প্রেসক্লাবের সেমিনারে বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া পরের দিন (২৫ অক্টোবর) থেকে বর্তমান সরকারকে অবৈধ বললে ও পরের দিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বিশাল সমাবেশে ২৪শে জানুয়ারির আগের নব্বই দিন হিসেব করে বলেছেন এ সরকার কার্যত ২৭ অক্টোবর থেকে অবৈধ । এই সমাবেশ থেকেই সাতাশ থেকে উনত্রিশ তারিখ পর্যন্ত ষাট ঘন্টার টানা হরতাল ঘোষিত হয়। যদি ও বক্তব্যে উল্লেখ করা হয় যদি আলোচনার পথ উন্মুক্ত না হয়, তবে এ কর্মসূচী কার্যকর হবে। সাংবিধানিক ভাবে অবৈধ বলাটা নীতিগত না হলেও ধরে নিতে হবে এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য এবং নেতা কর্মীদের রাজপথে উজ্জীবিত করার মন্ত্র। যদিও বেগম জিয়ার মুখ থেকে দুধরণের সময় লাইন ঘোষণা সচেতন নাগরিকদের চিন্তায় ফেলে দেয় কতটুকু হোমওয়ার্ক করছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই বিরোধী দল।
এর পরের দুদিন ছিল দু নেত্রীর ফোনালাপ নাটক। লাল টেলিফোন, সংযোগ পাওয়া না পাওয়া, শিডিউল সীমাবদ্বতা এবং সত্যিকারের সদিচ্ছা নাকি লোকদেখানো বিবিধ নাটককে পাশ কাটিয়ে ২৬শে অক্টোবর ২০১৩ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্নরণীয় হয়ে থাকবে দু নেত্রীর সাইত্রিশ মিনিটের কথোপকথনের কারণে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর (জুন ২০১১) মাধ্যমে যেহেতু এ সমস্যার উদ্ভব, তাই এক আলাপে আড়াই বছর আগে সৃষ্ট এ সমস্যা সমাধান হবেনা। তাইতো আটাশ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর ডিনার কাম আলোচনার আহবানকে রাজনীতিকভাবে মোকাবিলা করে বেগম জিয়া বলেছেন হরতাল শেষে অর্থাৎ উনত্রিশ তারিখের পর যে কোন সময়। প্রশ্ন উঠেছে, কেন খালেদা জিয়া হরতাল প্রত্যাহার করলেন না। বস্তুত এ মুহুর্তে বিএনপি র সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে সরকার বিরোধী তীব্র জনমত যার সর্বোত্তম ব্যবহার দলটি রাজপথে প্রমাণ করতে চায়। তাইতো ঘোষিত হরতাল কে তুলে নেওয়ার কৌশল দলটি নিতে চায়নি। দলটি হয়ত ভাবছে হরতাল তুলে নিলে সাময়িক বাহবা মিলবে কিন্তু নেতা কর্মীদের চাঙ্গাভাব ঢিলে হয়ে যেতে পারে। অপরদিকে সরকারী দলের মূল অস্ত্র হচ্ছে সংবিধান। সংশোধিত সংবিধানকে দোহাই দিয়ে তাই ক্ষমতাসীনরা নিজেদের বাগ্নীতার মাধ্যমে বিরোধীদের শানিত করছেন। হরতালের সংঘাত-প্রতিঘাতকে ছাপিয়ে এ মুহুর্তের আন্তরিক প্রতীক্ষা আর আকাংখা হচ্ছে ঊনত্রিশ তারিখের পর দু দল আলোচনায় বসা শুরু করবে আর একটি সমাধানের পথে এগিয়ে যাবে। সরকার প্রধান কে হবেন এ বিতর্কের অবসান সাত নভেম্বর সংসদের শেষ কার্যদিবসের আগেই হয়ে যাবে আশা করতে পারি।
যেহেতু ২৪শে জানুয়ারি এখন নব্বই দিনের ফ্রেমে চলে এসেছে, তাই নির্বাচন কমিশন এখন আলোচনার অন্যতম এজেন্ডা। সাংবিধানিক ভাবে পুরোপুরি শক্তি না থাকলে ও এ মুহুর্ত থেকে যদি নির্বাচন কমিশন লেবেল প্লে ফিল্ড নিশ্চিত করার কিছু এভিডেন্স দেখাতে পারে তবে তা হবে তাদের আস্থা অর্জনের অন্যতম কারণ। যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখন থেকেই সমালোচিত ডিসি, ইউএনও, এস পি বদলির সুপারিশ করেন সরকারের সর্বোচ্চ মহলে তা হবে সবচেয়ে কার্যকরী। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলে ও যে নির্বাচন কমিশন কে একই মিশনে কাজ করতে হবে। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত দু দলের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটানো মাঠ পর্যায়ে যাতে ২৪ জানুয়ারীর আগেই নবনির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়।
আপাতত প্রত্যাশিত মনে তাকিয়ে রয়লাম দুদলের খোলা মনের আলোচনার সম্ভাবনার দিকে। নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করে বিশ্ব রাজনীতিতে রুল মডেল হওয়ার এ চান্স মিস করতে আমরা কেন চাইব?