গেল সপ্তাহে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন হল। নানা দিক দিয়ে এবারের ইউপি নির্বাচন ব্যতিক্রমী, আলোচিত ও সমালোচিত। দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে বাংলাদেশে এবারই প্রথম ইউ পি নির্বাচন হচ্ছে।
গত ১৯ মার্চ, বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী প্রার্থী ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপায় না দেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়েছিলেন। নিজ উঠানে কবর খুঁড়ে কাফনের কাপড় পড়ে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই বিদ্রোহী প্রার্থী। পুলিশ সেখান থেকে তাঁকে উঠিয়ে সোজা কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। কবরবাসের চেয়ে কারাবাস উত্তম। এই ঘটনাটি হাস্যরস -বেদনাত্নক হলেও সমগ্র দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার গণতন্ত্রের সমন্বয়য়ের যেন রুপক শিল্পায়ন এটি।
নির্বাচনের প্রথম ধাপের প্রথম দুদিনেই নির্বাচনী ঝড়ে (সহিংসতায়) প্রাণ হারিয়েছে বাইশ জন। বরিশালের মুলাদী উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি, ইউনিয়ন পরিষদের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ আলী আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে কেবল নিজের কবর নিজেই খুঁড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবর খুঁড়তে হয়েছে বাইশটি। ভোট চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহত হাজারের উপর। তাদের অনেকেই হাঁসপাতালে হাঁসফাঁস করছেন, কাতরাচ্ছেন। নার্স, ডাক্তার তাদের শুশ্রূষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের চলমান নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যে রুগ্ন, অসুস্থ তাতে কোন সন্দেহ নেয়। কিন্তু কার বা কাদের সেবায় সুস্থ হবে এটি? কি বিজিবি মহাপরিচালক নতুবা নির্বাচন কমিশন কেউই এই অসুস্থতার দায় নিতে নারাজ। নির্বাচনী কমিশনার নিশ্চিন্তে বলেছেন, নির্বাচন অবাধ, সুস্থ হচ্ছে। সহিংসতায় তাদের কোন দায় নেয়।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি র তেমন মনঃসংযোগ নেয় বললেই চলে। “অংশগ্রহণই মূল কথা “ এই ধারণার উপর অনেকেই লড়ছেন। তাদের ভিতর অভ্যন্তরীণ গনতন্ত্র কতটা আছে তাও প্রশ্নের উদ্রেগ করে। আওয়ামীলীগের বেলায় এ উপমা প্রযোজ্য নয়। এবারের নির্বাচনের দুপ্রান্তেই তাদের অফিসিয়াল আওয়ামিলীগ বনাম বিদ্রোহী আওয়ামীলীগ। এ,বি টিমের এই দ্বন্ধ কখনো মনস্তাত্বিক, কখনো সাংঘর্ষিক। মাঝে মধ্যে এটি সংঘাতে রুপ নিচ্ছে। টাকার অবাধ ব্যবহার নেতাদের পেছন পেছন ঘুরছে, পাছে ‘এ’ টিমের মনোনয়ন পাওয়ার আশায়। পুলিশ আগে থেকেই সরকারি দল হিসেবে কাজ করে। এ নির্বাচনে তারা কখনো এ টিম কখনো বি টিম।
এই ইউপি নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী বনাম বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া না দেওয়াকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নতুন করে মাথাচারা দিচ্ছে। সম্প্রতি, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের নির্বাচন কে কেন্দ্র করে স্থানীয় সাংসদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের বিবৃতি, অভিযোগ তাই প্রমাণ দিচ্ছে। রামু উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এবারের ইউপি নির্বাচন দশ থেকে বারটি ধাপে সম্পন্ন হবে। ইতিমধ্যে দুটি ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। জয়ী প্রার্থীদের ৮০ শতাংশই আওয়ামিলীগ কিংবা বিদ্রোহী আওয়ামিলীগ। সরকারি দল এতে হয়ত খুশি, তাদের আত্নতৃপ্ত জনপ্রিয়তা দেখে। কিন্তু এ জনপ্রিয়তা কতটা আসল এবং নির্ভেজাল তা ভাবনার বিষয়।
অনেক দিক দিয়েই ব্যতিক্রম এবারের নির্বাচন। প্রথমত, ক্ষমতাসীন দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর একটি প্রশ্নবিদ্ধ্ব (!) নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আছে। যে নির্বাচনে অর্ধেকের ও বেশি সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত। এই বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত সাংসদরা যখন স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় প্রার্থী মনোনিত করবেন, তারা তখন কতটা ডেমোক্র্যাটিক থাকবেন, কতটা প্রকৃত নির্বাচনের পথে হাঁটবেন। স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের নিবিড়তাই বা কতটুকু।
দ্বিতীয়ত- এবারই প্রথম, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আগেই অনুমেয় ছিল। আমাদের দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দলীয়করণ। দুর্ভাগ্যবশত, পক্ষপাতদুষ্টতার গুরুতর অভিযোগ আমাদের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও রয়েছে। দলীয় প্রতীকে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য যে ধরণের শক্ত কমিশন দরকার, তা চলমান নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুপস্থিত। অতীতে অধিকাংশ প্রার্থীর দলীয় পরিচিতি থাকলেও ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক ব্যবহৃত হতো না। তাই নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত দলবাজ কর্মকর্তারাও তাঁদের দলীয় প্রার্থীদের প্রতি একধরনের নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতেন। ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হতো। কিন্তু দলভিত্তিক নির্বাচনে দলান্ধ কর্মকর্তারা তাঁদের দল মনোনীত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, যা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক মাস ধরে চলা পৌরসভা, ইউনিয়ন নির্বাচনে এসব অসামঞ্জস্যতা প্রতিফলিত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আগের সেই উৎসব, কোলাহল, প্রাণচাঞ্চল্য অনেকাংশেই অনুপস্থিত। দলীয় নির্বাচনের ফলে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্ক গুলি ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে বৈকি!
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনকে একটি বিকৃত ও আস্থাহীন নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনোনয়ন বানিজ্যের প্রভাব ও বিস্তৃতি এখন তৃনমূল পর্যায়ে পৌছে গেছে বলে আখ্যা দেন। এভাবে চলতে থাকলে গণতন্ত্রের কার্যকরিতা কতটুকু থাকে তা নিয়ে ও প্রশ্ন তুলেন তিনি।
পিরোজপুরের কোন এক ইউনিয়নে পছন্দের প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হলে উল্লাস করবেন বলে রং কিনে পকেটে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থক মোহাম্মদ কামাল। কিন্তু সেই রঙের বদলে তাঁর হাতে লেগেছে নিজের ভাই বেলালের রক্ত। নির্বাচনে গোলমাল ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন তার ভাই। শুধু নির্বাচনের সময় নয়, ফলাফল ঘোষণায় বাঁধা দেওয়ার অভিযোগ আছে হাজারো। প্রিজাইডিং অফিসার, ম্যাজিস্ট্রাট রা ও অনেক সময় কিংকর্তব্যবিমূড়, অসহায় হয়ে পড়ছেন।
কোন সন্দেহ নেয়, আমাদের গণতন্ত্র এ সময় একটি কঠিন সময় পার করছে। এই কাঠিন্য থেকে উত্তরিত হওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু এখন নির্বাচন নামের খোলসের মধ্যে আটকে গেছে প্রহসন আর বল্প্রয়োগ। যতদিন রাজনীতি থেকে বলপ্রয়োগ ও প্রহসনের বাড়াবাড়ি বিদায় না হবে, তত দিন নির্বাচন কমিশন কে “নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে” এ ধরণের বুলি আওড়াতেই থাকতে হবে। অথচ বাংলার ইতিহাসে বারবার নির্বাচন ও শান্তি সমার্থক ছিল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি জমিদারদের কংগ্রেস ও অভিজাত্দের মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। বাঙালি মুসলমানের রাজনীতির এই ধারাই ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নামে ভোটবিপ্লব ঘটিয়ে স্বাধীনতার দাবিকে আরো প্রচণ্ড ও অবধারিত করে তোলে। বৃটিশ ও পাকিস্তানিরা সুষ্ঠু নির্বাচনে ত্রাস হতে পারেনি। শান্তিপুর্ণ নির্বাচন সুস্থ গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত।
এখন গণতন্ত্র আছে লিখিত রুপে আর বাগ্নীতায়, সত্যিকারের গণতন্ত্র নিখোঁজ। নিখোঁজ গণতন্ত্রে নির্বাচন তো নির্বাসিত হবেই।।